ইতিহাসের জঘন্যতম নৃশংসতা। শুধু বাঙালি জাতির ইতিহাসে নয়, মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক কলঙ্কিত দিন। তাইতো বাঙালি জাতির জীবনে আজ এক বিভীষিকাময় বেদনাবিধুর রাত। আজ ২৫ মার্চ।
১৯৭১ সালের এইদিনের মধ্যরাতে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী উদ্যত হয় বাঙালিদের কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে। নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অপারেশন সার্চলাইটের নীলনকশা অনুযায়ী হত্যাযজ্ঞ চালায় রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে।
বর্বর হত্যাযজ্ঞের এ দিনটি এখন জাতীয় ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে। দিবসটি আন্তর্জাতিকভাবে পালনের জন্য স্বীকৃতি আদায়ের ক্ষেত্রেও কাজ চলছে। আর গণহত্যা দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাধীনতার জন্য প্রাণ উৎসর্গকারীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। সেই সঙ্গে প্রাণ উৎসর্গকারীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা অর্পন করছেন সমগ্র বাংলা ভাষা-ভাষী মানুষও।
অনেকের মতে, ২৫ মার্চের গণহত্যা শুধু এক রাতের হত্যাকাণ্ডই ছিল না, এটা মূলত বিশ্ব সভ্যতার জন্য এক কলঙ্কজনক ও জঘন্যতম গণহত্যার সূচনা। অস্ট্রেলিয়ার 'সিডনি মর্নিং হেরাল্ড' পত্রিকার ভাষ্য মতে, শুধুমাত্র ২৫ মার্চ রাতেই বাংলাদেশে প্রায় এক লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, যা গণহত্যার ইতিহাসে এক জঘন্যতম ভয়াবহ ঘটনা।'
মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মার্চের রাত সম্পর্কে লিখেছিলেন, 'ঢাকায় ঘটনার শুরু মাত্র হয়েছিল। সমস্ত পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চললো মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করলো ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট। লুট আর ধ্বংস তাদের নেশায় পরিণত হলো। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শেয়ালের খাবারে পরিণত হলো। বাংলাদেশ হয়ে উঠলো শকুনতাড়িত শ্মশান ভূমি।'
ইতিহাস বলে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টো মিলে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করতে থাকেন। সেই সময় বাঙালিদের ওপর সামরিক হত্যাযজ্ঞের নীলনকশা চূড়ান্ত করা হয়। আর জল্লাদ ইয়াহিয়ার নির্দেশে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের আঁধারে সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে আসে পাকিস্তানি হানাদারদের ট্যাংক আর সাঁজোয়া যানের বহর।
আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘুমন্ত সাধারণ মানুষের ওপর। পাকবাহিনীর ট্যাংক, কামান আর মেশিনগানের গোলায় প্রাণ হারায় হাজার হাজার কিশোর, তরুণ, যুবক থেকে শুরু করে সববয়সী মানুষ। নারকীয় এক হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে হিংস্র হায়েনারা। যেখানে যাকে পেয়েছে তাকেই গুলি করে হত্যা করেছে।
হানাদার বাহিনী হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে পিলখানার ইপিআর সদর দফতর, রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রাবাস, ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ নগরীর বিভিন্ন এলাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল আর ইকবাল হলে শুরু করে নির্বিচারে গণহত্যা। চলতে থাকে লুটপাট, লুণ্ঠন। রক্তে রঞ্জিত হয় ঢাকার রাজপথ।
শুধু হত্যাই নয়, আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয় শহরের বিভিন্ন এলাকায়। একই সঙ্গে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয় অন্যান্য বড় শহরেও। মানবজাতির ইতিহাসে এমন বর্বরতার দ্বিতীয় কোনো নজির নেই। গোটা বাঙালি জাতি এ মানবতাবিরোধী হামলায় হতভম্ব হয়ে গেলেও তীব্র এক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পুলিশ ও ইপিআর সদস্যরা বীরত্বের সঙ্গে কঠিন প্রতিরোধ করে।
২৫ মার্চ রাতের শেষ প্রহর তথা ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ঘোষণা দেন। দেশের সর্বত্র শুরু হয় সশস্ত্র সংগ্রাম ও স্বাধীনতা যুদ্ধ। অকুতোভয় বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জন করা হয় একটি স্বাধীন সার্বভৌম মাতৃভূমি; বাংলাদেশ।
দিবসটি উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির যৌথ উদ্যোগে ‘গণহত্যা দিবস’ পালন করা হবে। দিবসটির মর্যাদা অনুযায়ী সভা, সমাবেশ, র্যালি, আলোকচিত্র প্রদর্শনীসহ নানান কর্মসূচি পালন করবে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, মুক্তিযুদ্ধ ’৭১সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন।
0 comments: